নিবিড় কৃষির অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য
পৃথিবীর যে সকল অঞ্চলের জনঘনত্ব খুব বেশি এবং কৃষি জমির পরিমাণ সীমিত সেখানে প্রচুর শ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগ করে মূলত জীবনধারণের উদ্দেশ্যে যে কৃষি পদ্ধতিতে সর্বাধিক ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়, সেই শ্রমনিবিড় কৃষি ব্যবস্থাকে প্রগাঢ় বা নিবিড় কৃষি বলা হয়।
নিবিড় কৃষির অবস্থান:
নিবিড় কৃষি কাজের সঙ্গে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যুক্ত রয়েছে। পৃথিবীর অধিক জনঘনত্বপূর্ণ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই কৃষি পদ্ধতির প্রচলন দেখা যায়। পৃথিবীর যেসব দেশে নিবিড় কৃষির প্রচলন রয়েছে সে দেশ গুলি হল –
A. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়া: ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিনস, লাওস, কম্বোডিয়া, জাপান, চীন ও তাইওয়ান প্রভৃতি দেশে।
B. ইউরোপ মহাদেশ: ইউরোপ মহাদেশের ইতালির পতাকা নেদারল্যান্ডের পোল্ডার ভূমি, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য এবং ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহে।
C. আফ্রিকা মহাদেশ: মিশরের নীলনদ অববাহিকা, ইথিওপিয়া ও সুদান প্রভৃতি দেশে।
নিবিড় কৃষির বৈশিষ্ট্য:
মূলত জীবনধারণের জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয় বলে নিবিড় কৃষি প্রকৃতপক্ষে জীবিকাসত্ত্বাভিত্তিক কৃষি। এই কৃষিব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
1. প্রাকৃতিক পরিবেশ: পৃথিবীর ক্রান্তীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর জনঘনত্ব পূর্ণ সমভূমি অঞ্চলে নিবিড় কৃষির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
2. জমির পরিমাণ: জমির উপর জনসংখ্যার প্রভাব চাপ থাকায় চাহিদার তুলনায় জমির পরিমাণ কম এবং কৃষিজমি গুলি ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত।
3. পেশিশক্তি ও কায়িক শ্রম নির্ভর: নিবিড় কৃষিতে জমি প্রস্তুত, চারাগাছ রোপন, রক্ষণাবেক্ষণ, সার প্রয়োগ ও ফসল কাটা প্রভৃতি কাজের জন্য প্রধানত পশু শক্তি ও মানুষের দৈহিক শ্রমের ব্যবহার করা হয়।
4. যন্ত্রপাতির ব্যবহার: এই কৃষি ব্যবস্থায় কৃষকদের মূলধনের অভাব থাকায় প্রাচীন কৃষি যন্ত্রপাতি যথা লাঙল, কোদাল, কাস্তে ইত্যাদির সাহায্যে চাষাবাদ করা হয়। তবে উন্নত দেশগুলি, যেমন- চিন, জাপান, জার্মানি প্রভৃতি দেশে ট্রাক্টর, হারভেস্টার ইত্যাদি উন্নত ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়।
5. প্রযুক্তির ব্যবহার: নিবিড় কৃষিতে উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, জলসেচ ও উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। তবে এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি হয়।
6. বহুফসলি কৃষি: নিবিড় কৃষিতে সারা বছর ধরে জলসেচ ও সার প্রয়োগের মাধ্যমে দুই থেকে তিনবার ফসল ফলানো হয়। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফসলের চাষ করা হয়।
7. উৎপন্ন ফসল: নিবিড় কৃষির প্রধান ফসল হয় ধান। এছাড়াও ধানের সঙ্গে গম, ইক্ষু, জব, বার্লি, তৈলবীজ ও ডাল জাতীয় শস্যও চাষ করা হয়।
8. উৎপাদনশীলতা: উচ্চ ফলনশীল বীজ, কীটনাশক, জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উপযুক্ত পরিচর্চায় কৃষি কাজ করা হয় বলে নিবিড় কৃষির হেক্টরপ্রতি শস্য উৎপাদন অনেক বেশি। কিন্তু জনসংখ্যার চাপ অধিক থাকায় মাথাপিছু উৎপাদন কম হয়।
9. জীবিকাসত্ত্বাভিত্তিক চরিত্র: জনসংখ্যার অনুপাতে জমির পরিমাণ কম হওয়ায় খাদ্যশস্যের চাহিদা প্রচুর। তাই কৃষকেরা প্রধানত জীবিকা নির্বাহের জন্য খাদ্যশস্য চাষ করে থাকেন।
10. অন্যান্য কাজ: নিবিড় কৃষি ব্যবস্থায় কৃষকেরা ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি পশুপালন, মাছ ধরা, বনজ সম্পদ সংগ্রহ এবং মৌমাছি প্রতিপালনও করে থাকে।
11. ফসলের উদ্বৃত্ততা: অধিক জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের কৃষি কাজ প্রচলিত থাকায় ফসলের অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে কাজে লাগে ফলে খুব সামান্য পরিমাণ ফসল উদ্বৃত্ত থাকে।
12. বাণিজ্য ও আর্থিক অবস্থা: নিবিড় কৃষিতে উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তিতে কৃষি কাজের ফলে বর্তমানে উদ্বৃত্ত ফসলের পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন অর্থকারী ফসল, যেমন পাট, ইক্ষু, তলো চাষের ফলে বাণিজ্যিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কৃষিতে কৃষকদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল।