নিবিড় কৃষি ও ব্যাপক কৃষির পার্থক্য

 জীবিকাসত্ত্বাভিত্তিক কৃষি বাণিজ্যিক কৃষির পার্থক্য:

নিবিড় কৃষি: জমির তুলনায় অধিক জনবসতি যুক্ত অঞ্চলে জীবিকাসত্ত্বাভিত্তিক উদ্দেশ্যে প্রচুর কায়িক শ্রম পুঁজি বিনিয়োগ করে ক্ষুদ্র জমিতে যে পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা হয় তাকে নিবিড় বা প্রাগঢ় বা জীবিকাসত্ত্বাভিত্তিক কৃষি বলা হয়।
 
 
ব্যাপক কৃষি: জমির তুলনায় স্বল্প জনবসতি যুক্ত অঞ্চলে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অল্প কায়িক শ্রম, অধিক যন্ত্রপাতি জড়শক্তির ব্যাপক প্রয়োগে সুবিস্তৃত জমিতে যে কৃষি পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা হয় তাকে ব্যাপক বা বাণিজ্যিক কৃষি বলা হয়।
 
 
নিবিড় কৃষি ব্যাপক কৃষির উল্লেখযোগ্য পার্থক্য গুলি হল
 
1. অবস্থান:
নিবিড় কৃষি: প্রজাতন্ত্র ক্রান্তীয় অঞ্চলের জনবহুল দেশ সমূহে এই কৃষি ব্যবস্থা প্রচলিত। প্রধান অঞ্চল হল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া।
 
ব্যাপক কৃষি: প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে কম জনবহুল  দেশ সমূহে কৃষি ব্যবস্থা প্রচলিত। প্রধান অঞ্চল হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউক্রেন, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি।
 
2. জমির আয়তন:
নিবিড় কৃষি: কৃষি জমির আয়তন ক্ষুদ্র হয়।
 
ব্যাপক কৃষি: কৃষি জমির আয়তন বিশালাকার হয়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গম চাষের জন্য ব্যবহৃত জমি 350 থেকে 800 হেক্টরের মধ্যে হয়।
 
3. জনসংখ্যার চাপ:
নিবিড় কৃষি: জনসংখ্যার তুলনায় কৃষি জমির পরিমাণ কম হওয়ায় জমির ওপর চাপ বেশি।
 
ব্যাপক কৃষি: জনসংখ্যার তুলনায় কৃষি জমির পরিমাণ বেশি হওয়ায় জমির ওপর চাপও কম।
 
4. উৎপাদন:
নিবিড় কৃষি: ফসলের সঠিক পরিচর্যা, সার প্রয়োগ, উচ্চ ফলনশীল বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি প্রয়োগে হেক্টরপ্রতি শস্য উৎপাদন অনেক বেশি।
 
ব্যাপক কৃষি: কৃষি জমিগুলির আকার বড় হওয়ায় ফসলের সঠিক পরিচর্যা হয়না, সঠিকভাবে সার কীটনাশক প্রয়োগ করা যায় না, ফলে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন তুলনামূলক কম।
 
5. মাথাপিছু উৎপাদন:
নিবিড় কৃষি: জনসংখ্যার চাপ বেশী হওয়ায় মোট উৎপাদন বেশি হলেও মাথাপিছু উৎপাদন অনেক কম।
 
ব্যাপক কৃষি: মোট উৎপাদন কম হলেও জনসংখ্যার চাপ কম হওয়ায় মাথাপিছু উৎপাদন তুলনামূলক বেশি।
 
6. শ্রম নির্ভরতা:
নিবিড় কৃষি: প্রাচীন পদ্ধতিতে লাঙ্গল, কোদাল  প্রভৃতি হস্তচালিত উপকরণ নির্ভর হওয়ায়, এই কৃষি পদ্ধতি কায়িক শ্রম ভিত্তিক।
 
ব্যাপক কৃষি: কৃষিজমি গুলি বৃহদায়তন হওয়ায়  যান্ত্রিকীকরণের প্রাধান্য থাকে বলে কায়িক শ্রম কোন প্রয়োজন হয়।
 
7. শ্রমিকের মজুরি:
নিবিড় কৃষি: জনঘনত্ব বেশি হওয়ায় কৃষি শ্রমিকের মজুরি অনেক কম। কৃষিক্ষেত্রে ছদ্ম বেকারত্ব দেখা যায়।
 
ব্যাপক কৃষি: জনঘনত্ব কম হওয়ায় বেশিরভাগ কাজ যান্ত্রিক নির্ভর, তবে সামান্য যে শ্রমিকের প্রয়োজন হয় তার মজুরী অনেক বেশি।
 
8. শ্রমিকের যোগ্যতা:
নিবিড় কৃষি: অধিকাংশ কৃষিশ্রমিক নিরক্ষর এবং কৃষির বেশিরভাগটাই অভিজ্ঞতানির্ভর।
 
ব্যাপক কৃষি: এই কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকরা সুশিক্ষিত এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি প্রয়োগে দক্ষ।
 
9. উদ্দেশ্য:
নিবিড় কৃষি: পারিবারিক চাহিদা পূরণ স্থানীয় প্রয়োজনে ফসল উৎপাদন করা হয়।
 
ব্যাপক কৃষি: রপ্তানির উদ্দেশ্যে ফসল উৎপাদন করা হয়।
 
10. যন্ত্রনির্ভরতা:
নিবিড় কৃষি: প্রাচীন পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। ভারী যন্ত্রপাতি, যেমন- ট্রাক্টর, হারভেস্টার ইত্যাদি ব্যবহার হয় না।
 
ব্যাপক কৃষি: আধুনিক উন্নত মানের যন্ত্রপাতি, যেমন- ট্রাক্টর, হারভেস্টারথ্রেসার প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে চাষ করা হয়।
 
11. সার ব্যবহার:
নিবিড় কৃষি: কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য মূলত জৈব সার ব্যবহার করা হয়।
 
ব্যাপক কৃষি: কৃষি জমির উর্বরতা বাড়াতে জৈব রাসায়নিক উভয় সার ব্যবহার করা হয়।
 
12. মূলধন:
নিবিড় কৃষি: শ্রমিকের মজুরি, সার প্রয়োগ উচ্চ ফলনশীল বীজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগ প্রয়োজন হলেও তবে তা ব্যাপক কৃষির তুলনায় কম।
 
ব্যাপক কৃষি: উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং উন্নত মানের যন্ত্রপাতি যেমন ট্রাক্টর, হারভেস্টার, থ্রেসার প্রভৃতির ব্যবহারে প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করা হয়।
 
13. প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব:
নিবিড় কৃষি: প্রাকৃতিক পরিবেশের সুস্পষ্ট প্রভাব নিবিড় কৃষি দেখা যায়।
 
ব্যাপক কৃষি: প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রভাব থাকলেও মানুষের প্রযুক্তি, জ্ঞান ব্যাপক কৃষিতে কার্যকরী ভূমিকা নেয়।
 
14. উৎপন্ন ফসল:
নিবিড় কৃষি: ধান প্রধান ফসল হলেও তৈলবীজ, ডাল, মিলেট জাতীয় শস্য চাষ করা হয়।
 
ব্যাপক কৃষি: এই কৃষির প্রধান ফসল গম, তাছাড়া অন্যান্য ফসল হল ভুট্টা, ওট, বার্লি সোয়াবিন ইত্যাদি।
 
15. ফসল ব্যবস্থা:
নিবিড় কৃষি: জনসংখ্যার চাপ বেশী থাকায় কৃষকরা একই জমিতে বছরে 2/3 বার ফসল চাষ করে থাকে।
 
ব্যাপক কৃষি: কৃষিজমি গুলি মূলত এক ফসলি। জমির ওপর চাপ বাড়লে কৃষিজমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব।
 
16. বাণিজ্য:
নিবিড় কৃষি: জনসংখ্যা অধিক থাকায় ফসল বিসিএস উদ্বৃত্ত থাকে না বলে এটি বাণিজ্যিক নয়। নিবিড় কৃষি মূলত জীবিকাসত্ত্বাভিত্তিক কৃষি।
 
ব্যাপক কৃষি: জনসংখ্যার চাপ কম হওয়ায় প্রচুর ফসল উদ্বৃত্ত থাকে। যা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বাজারে প্রেরিত হয়। মূলত বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে প্রকার কৃষি কাজ করা হয়।
 
17. আন্তর্জাতিক বাজার নির্ভরতা:
নিবিড় কৃষি: স্থানীয় চাহিদা পূরণ এবং নিজেদের জীবন ধারণের উদ্দেশ্যে এই কৃষি কাজ করা হয় বলে নিবিড় কৃষি আন্তর্জাতিক বাজার নির্ভর নয়।
 
ব্যাপক কৃষি: মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার উপর নির্ভর করে ব্যাপক কৃষি কাজ করা হয়। তাই আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা কৃষি শস্যের মূল্য ব্যাপক কৃষিকে প্রভাবিত করে।
Theme images by chuwy. Powered by Blogger.
close