শস্যাবর্তন | Crop Rotation

শস্যাবর্তন (Crop Rotation): 

অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে জমির উর্বরতা বজায় রাখার জন্য বছরের বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ফসল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উৎপাদন করাকে শস্যাবর্তন বলে।
 

A. শস্যাবর্তনের অবস্থান:

পৃথিবীর সর্বপ্রথম সার্থক শস্যাবর্তন শুরু হয়েছিল প্রাচীন রোমে নিবিড় কৃষি মিশ্র কৃষি ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি অঞ্চলে শস্যাবর্তন অধিক মাত্রায় প্রয়োগ দেখা যায়। জাপান, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম স্পেন প্রভৃতি দেশে শস্যাবর্তন পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।
 
ভারতের আর্দ্র কৃষি বলে শস্যাবর্তন দেখা যায়। ভারতের পাঞ্জাব হরিয়ানা রাজ্যের সবুজ বিপ্লবের সুফল হিসেবে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে শস্যাবর্তন অনুসৃত হয় এবং পরবর্তীকালে প্রায় সমগ্র ভারতে তা ছড়িয়ে পড়ে।
 

B. শস্যাবর্তনের উদ্দেশ্য:

শস্যাবর্তনের প্রধান দুটি উদ্দেশ্য হল
1. জমির উর্বরতা বজায় রাখা: বছরের পর বছর জমিতে একই ফসল চাষ করলে জমির উর্বরতা কমে যায়। কিন্তু একই জমিতে বছরে দুই বা তার বেশি ফসল চাষ করলে জমির উর্বরতা অনেকাংশে বজায় থাকে।
 
2. উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: পৃথিবীর জনসংখ্যা অতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি না করলে খাদ্য সংকট দেখা যাবে। তাই সমগ্র পৃথিবীতে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে শস্যাবর্তন পদ্ধতি অনুসরণ করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে অধিক উৎপাদনের সাহায্যে পৃথিবীর খাদ্যের চাহিদা মেটানো।
 
3. শস্যের বৈচিত্র্য: শস্যাবর্তন পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন শস্য উৎপাদন করে প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদা পূরণ।
 
4. শস্য সুরক্ষা: রক পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে শস্য কে যতটা বেশি মাত্রায় রক্ষা করা সম্ভব।
 

C. শস্যাবর্তন পদ্ধতির অনুকূল ভৌগলিক পরিবেশ:

জমিতে শস্যাবর্তন পদ্ধতিতে কি কি ফসল চাষ করা হবে তা নির্ভর করে
 
1. উচ্চফলনশীল বীজ, সার কীটনাশকের যোগান।
 
2. বর্ষাকালের দৈর্ঘ্য।
 
3. মাটিতে আর্দ্রতার উপস্থিতি জলসেচের সুবিধা।
 
4. মাটির গুণগত
 
5. ফসল ফলানোর প্রয়োজনীয় সময়।
 
6. উৎপন্ন ফসলের চাহিদা বাজার।
 
7. ফসল উৎপাদনে ঝুঁকি কতটা তার উপর।
 

D. শস্যাবর্তনের পদ্ধতি:

আবর্তনের প্রধান দুটি পদ্ধতি হল
 
I. পর্যায়ভিত্তিক শস্যাবর্তন পদ্ধতি:
1. প্রথম পর্যায়: মানুষ প্রাণীর প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান উৎপাদন। যেমন- ধান, গম, ভুট্টা, আলু প্রভৃতি।
 
2. দ্বিতীয় পর্যায়: পশুখাদ্যের জন্য মাটিতে নাইট্রোজেন স্থিতিকারী ঘাস ঘাস জাতীয় উদ্ভিদের চাষ। যেমন- আলফা আলফা, ক্লোভার ইত্যাদি।
 
3. তৃতীয় পর্যায়: পশুচারণ ক্ষেত্র হিসেবে কৃষি জমির ব্যবহার।
 
4. চতুর্থ পর্যায়: বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বাজারমুখী অর্থকরী ফসলের চাষ।
 
 
II. বছরভিত্তিক শস্যাবর্তন পদ্ধতি: একই কৃষিজমিতে বিভিন্ন বছরে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন করা হয়। যেমন-
1. প্রথম বছর: ধান গম ভুট্টা জাতীয় খাদ্যশস্যের উৎপাদন।
 
2. দ্বিতীয় বছর: নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী মটর, কলাই প্রভৃতি শুঁটি জাতীয় ডাল ফসলের উৎপাদন।
 
3. তৃতীয় বছর: সূর্যমুখী, সরষে জাতীয় তৈলবীজ বা হিউমাস বৃদ্ধিকারী মিলেট জাতীয় পশুখাদ্য উৎপাদন।
 
4. চতুর্থ বছর: আখ, তামাক জাতীয় প্রচুর উর্বরতা চাহিদা যুক্ত ফসল উৎপাদন করলে জমির পুষ্টিগুণ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
 

E. শস্যাবর্তনের বৈশিষ্ট্য:

এই পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল
 
1. জলবায়ু নির্ভর: অঞ্চল জলবায়ুর পার্থক্য অনুসারে শস্যাবর্তন পর্যায়ের তারতম্য ঘটে থাকে।
 
2. বিভিন্ন শস্যের পরপর চাষ: বছরের বিভিন্ন সময়ে একটি নির্দিষ্ট কৃষিজমিতে পরপর বিভিন্ন ধরনের শস্য চাষ করা হয়। শস্যাবর্তন পদ্ধতি পর্যায়ে দানাশস্য শুঁটি জাতীয় শস্য চাষ করা হয়।
 
3. মানুষের খাদ্য পশুখাদ্যের চাষ: প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুসারে মানুষের খাদ্য পুষ্টি খাদ্য একসঙ্গে চাষ করা হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে দানাশস্য, শুঁটি শস্য ঘাস চাষ করা হয়।
 
4. জমির স্বাভাবিক উর্বরতা: জমিতে শুঁটি জাতীয় শস্য চাষের করা হয় বলে বাতাস থেকে মুক্ত নাইট্রোজেন জমিতে সঞ্চিত হয়। তাছাড়াও বিভিন্ন শস্যের চাষ হওয়ায় জমির পুষ্টিমৌল্য বজায় তথা জমির স্বাভাবিক উর্বরতা বজায় থাকে।
 
5. দীর্ঘ সময়: একটি শস্যাবর্তন পদ্ধতি সম্পূর্ণ হতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় প্রয়োজন হয়।
 

F. শস্যাবর্তনের সুবিধা বা গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা:

শস্যাবর্তন পদ্ধতিতে কৃষি ক্ষেত্রে যে সকল সুবিধা গুলি পাওয়া যায়
 
1. জমির উর্বরতা বজায়: শস্যাবর্তন পদ্ধতিতে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয় বলে জমিতে দীর্ঘদিন উর্বরতা বজায় থাকে। ফলে জমিতে সারের প্রয়োগ খুব বেশি প্রয়োজন হয় না।
 
2. পুষ্টি মৌলের ব্যবহার: বিভিন্ন উদ্ভিদের গাছের শিকড় মাটির বিভিন্ন গভীরে প্রবেশ করে বলে মাটির পুষ্টি মৌলের সার্বিক ব্যবহার হয়।
 
3. জৈব পদার্থের যোগান বৃদ্ধি: বিভিন্ন উদ্ভিদ মাটিতে বিভিন্ন ধরনের জৈব পদার্থ যোগান দেয়।
 
4. উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: শস্যাবর্তনের মাধ্যমে জমির বিভিন্ন পুষ্টিমৌল্য বজায় থাকে বলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
 
5. আগাছা বিলোপ: শস্যাবর্তন কৃষি পদ্ধতিতে সর্বদায় ফসল উৎপাদিত হবে বলে জমি সারা বছর ধরে আগাছামুক্ত থাকে।
 
6. ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি: শস্যাবর্তন পদ্ধতিতে জমিতে বিভিন্ন ফসল পরপর নিবিড় ভাবে চাষ করা হয় বলে শস্য উৎপাদনের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
 
7. ঝুঁকিহীন কৃষি: শস্যাবর্তন কৃষি পদ্ধতিতে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শস্য চাষ করা হয় বলে কোন ফসলের উৎপাদন হ্রাস পেলে, অন্য ফসল উৎপাদন স্বাভাবিক থাকে। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ খুব কম হয়।
 
8. স্বল্প উৎপাদন ব্যয়: মানুষ খাদ্যের পাশাপাশি পশুখাদ্য চার্জ করা হয় বলে শস্যাবর্তন পদ্ধতি কৃষকদের চাষের ্যয়    অনেকটাই কম থাকে।
 
9. কম ক্ষতি লাভ বেশি: একই জমিতে বিভিন্ন শস্য চাষ করা হয় বলে সারাবছর ফসলের চাহিদা অনুযায়ী বাজারমূল্য অধিক পাওয়া যায়। ফলে কৃষকের লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষতির সম্ভাবনা প্রায় থাকে না বললেই চলে।
 
10. বেশি কর্মদিবস সৃষ্টি: সারা বছর ধরে বিভিন্ন কৃষিজ ফসল চাষ হওয়ায় কৃষক শ্রমিক সারা বছর ধরে কাজ পায়। ফলে কৃষিতে কর্মদিবসের সংখ্যা বেশি হয় এবং গ্রামাঞ্চলে ছদ্ম বেকারত্বের পরিমাণ কম হয়।
 
 
Theme images by chuwy. Powered by Blogger.
close