কৃষির আধুনিক উপকরণ

কৃষিকাজে আধুনিক উপাদান:

কৃষিকাজ একটি প্রাথমিক স্তরের অর্থনৈতিক কাজ এবং সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। কৃষির এই পরিবর্তনে বিজ্ঞান প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে কৃষিকাজে আধুনিক উপকরণের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

কৃষিকাজে আধুনিক উপকরণের প্রয়োজনীয়তা:

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষিকাজে আধুনিক  উপকরণের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য কারণ গুলি হল
 
1. উৎপাদন বৃদ্ধি: পৃথিবীর জনসংখ্যা যেভাবে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এই অধিক জনসংখ্যার খাদ্য সরবরাহ সুনিশ্চিত করার জন্য কৃষিকাজে আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়।
 
2. চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি: যেখানে কৃষির প্রসার ঘটেনি অর্থাৎ পতিত জমিতে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি জলসেচসহ আধুনিক উপাদানগুলির প্রয়োগ করে কৃষি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়।
 
3. দারিদ্র অসাম্য দূরীকরণ: আধুনিক উপকরণের প্রয়োগে কৃষিকাজে দ্রুত বিকাশের মাধ্যমে কৃষকদের দারিদ্র্য অসাম্য দূরীকরণ সম্ভব।
 
4. বহুফসলি চাষ: কৃষিকাজে আধুনিক উপকরণের প্রয়োগ করে একফসলি জমিকে দুই বা বাহুফসলি জমিতে পরিণত করে শস্য প্রগাঢ়তা বৃদ্ধি করা যায়।
 
5. গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন: ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে গ্রাম অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। তাই কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক উপাদানগুলির ব্যবহার করে গ্রামীণ মানুষের উপার্জন বৃদ্ধি এবং কৃষির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই গ্রামীণ অর্থনীতি সুদৃঢ় হয়।
 
6. অন্যান্য সুবিধা: এছাড়াও কৃষিকাজে আধুনিক উপাদানগুলি প্রয়োগের ফলে কৃষকের শ্রম হ্রাস, দ্রুত উৎপাদন, উদ্বৃত্ত উৎপাদন, লাভজনক কৃষিকাজ শস্য সংরক্ষণ ইত্যাদি সুবিধা পাওয়া যায়
 

কৃষিতে আধুনিক উপাদান:

কৃষিকাজে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যে সকল আধুনিক কৃষি উপকরণের প্রয়োজন সেগুলি হল 1.জলসেচ, 2.উচ্চফলনশীল বীজ, 3.রাসায়নিক সার, 4.কীটনাশক ওষুধ, 5.আধুনিক যন্ত্রপাতি।
 

1.জলসেচ: 

পৃথিবীর সর্বত্র বৃষ্টিপাতের বন্টন সমান নয়। ফলে কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য চাহিদা অনুসারে সঠিক সময়ে, পরিমিত মাত্রায় কৃত্রিম উপায় জল সরবরাহ ব্যবস্থাকে জলসেচ বলে।
 
A. উদাহরণ: জলসেচের প্রধান তিনটি মাধ্যম হল খাল জলসেচ, কূপ-নলকূপ জলসেচ জলাশয় জলসেচ পদ্ধতি। এছাড়াও ফোয়ারা, অববাহিকা, কিনারা এবং বিন্দু পদ্ধতিতেও জলসেচ করা হয়।
 
B. গুরুত্ব:
1. জলসেচের সাহায্যে সারা বছর ধরে বহুফসলি চাষের ফলে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
 
2. উচ্চফলনশীল শস্য চাষের অতিরিক্ত জলের চাহিদা পূরণ করা যায়।
 
3. শুষ্ক অঞ্চলে জলসেচের সাহায্যে কৃষিজমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
 

2. উচ্চফলনশীল বীজ: 

অতি অল্প সময়ে অধিক দ্রুত ফলনশীল শস্যবীজকে উচ্চ ফলনশীল বীজ বলা হয়। অধ্যাপক নরম্যাল বোরলোগ 1960-1970 এর মধ্যে মেক্সিকোতে নতুন ধরনের উচ্চফলনশীল গমের বীজ উদ্ভাবন করেন। যা কৃষিক্ষেত্রে শস্য উৎপাদনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
 
A. উদাহরণ:
1. গম- কল্যাণসোনা, হীরা, সোনালিকা সোনারা প্রভৃতি।
 
2. ধান- জয়া, পদ্মা, যমুনা, পঙ্কজ, রত্না, গোবিন্দ আদিত্য প্রভৃতি।
 
3. ভুট্টা- নবজোত, বায়ো, গঙ্গা, পর্বত ডেকান প্রভৃতি।
 
 
B. গুরুত্ব:
চিরাচরিত বীজের তুলনায় HYV বীজের ব্যবহারে অনেক সুবিধা রয়েছে-
 
1. HYV বীজের ব্যবহারে ফলন মাত্রা সাধারণ বীজের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
2. HYV বীজের ব্যবহারে খুব স্বল্প সময়ে কৃষিজ ফসল উৎপন্ন করা যায়।
 
3. HYV বীজের ব্যবহারে দ্রুত ফসল উৎপাদনের জন্য অধিক পরিচর্যার প্রয়োজন হয় যা অধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান ঘটে।
 
4. HYV বীজের ব্যবহারে অধিক উৎপাদনের জন্য কৃষক স্বল্প জমিতে কৃষিকাজ করতে পারে।
 

3. রাসায়নিক সার: 

কৃষিক্ষেত্রে উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহারে রাসায়নিক সারের গুরুত্ব অপরিসীম। মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস পটাশিয়াম প্রভৃতি প্রধান পুষ্টি মৌলের অভাবে পূরণে  বিভিন্ন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়।
 
A. উদাহরণ: NPK, ইউরিয়া, পটাশ ফসফেট প্রভৃতি।
 
B. গুরুত্ব:
1. মাটিকে উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহারের উপযুক্ত করে তুলতে রাসায়নিক সারের গুরুত্ব অপরিসীম।
 
2. বিপুল পরিমাণে খাদ্যশস্য অর্থকারী শস্য উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক সারের ব্যবহার প্রয়োজন।
 
3. স্বল্প সময়ে ফসল উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক সারের গুরুত্ব অনেক।
 
পরিবেশ মাটির অবনমন রক্ষার্থে উন্নত দেশে বর্তমানে অধিকমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
 

4. কীটনাশক ওষুধ: 

কৃষিক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উপকরণ হল কীটনাশক ওষুধ। উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহারে সবচেয়ে অধিক মাত্রায় রোগ পোকার আক্রমণ দেখা যায়। এই জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর উপযুক্ত মাত্রায় কীট-ছত্রাক আগাছা নাশক রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করে রোগ পোকার আক্রমণ এবং আগাছার উপদ্রব থেকে ফসলকে রক্ষা করা সম্ভব।
 
A. প্রকার: সাধারণত কৃষিক্ষেত্রে তিন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়
1. স্পর্শ বিষ: এই ধরনের কীটনাশক এর সংস্পর্শে এলেই কীটপতঙ্গ মারা যায়। যথা নিকোটিন, অলড্রিন, কেলথেন, ফলিডল প্রভৃতি।
 
2. পাকস্থলীয় বিষ: এই ধরনের কীটনাশক কীটপতঙ্গ খাওয়ার পরে পেটের মধ্যে বিষক্রিয়ায় মারা যায়। যথা আর্সেনিক যৌগ জিঙ্ক ফসফাইড উল্লেখযোগ্য।
 
3. ধুম বিষ: এই বিষয়ে ধোঁয়ায় কীটপতঙ্গ মারা যায়। যথা কার্বন ডাই সালফাইড, ক্যালসিয়াম সায়ানাইড মিথাইল ব্রোমাইড প্রভৃতি।
 
B. গুরুত্ব:
1. শস্য চারা কীট পতঙ্গের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
 
2. আগাছা নির্মূল করা যায়।
 
3. পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
 

5. আধুনিক যন্ত্রপাতি: 

শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষিকাজে ব্যাপক হারে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। বহুফসলি চাষ এবং অধিক মাত্রায় উৎপাদনের জন্য আধুনিক উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
 
A. উদাহরণ: আধুনিক কৃষিক্ষেত্রে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয় সেগুলি হল
 
1. চাষের জন্য: ট্রাক্টর পাওয়ার টিলার লেভেলার
 
2. বীজতলা তৈরি: পুডলার, ডিস্ক হারো ডিস্ক প্লাউ।
 
3. বীজ বপন: সিডড্রিল, তিফান প্ল্যান্টার ইত্যাদি।
 
4. রোগ দমন: বাকেট, এয়ারপ্লেন, কম্প্রেসার, স্পেয়ার প্রভৃতি।
 
5. শস্য কাটা: হারভেস্টার, থ্রেসার, রিপার প্রভৃতি।
 
6. শস্য ঝাড়া: শস্য ঝাড়াই এর জন্য উইনোয়ার।
 
B. গুরুত্ব:
1. উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
2. বহুফসলি জমির পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
3. আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষিকাজ অনেক সহজ বৃহদায়তন হয়েছে।
 
4. উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেয়েছে।
 
5. বাণিজ্যিক কৃষির সূত্রপাত হয়েছে
 
 
উপরিউক্ত আধুনিক কৃষির উপকরণ গুলি ছাড়াও কৃষির সার্বিক উন্নয়নের জন্য ভূমি সংস্কার উপযুক্ত উৎপন্ন ফসল বিক্রির বাজার প্রয়োজন। উৎপন্ন ফসল যদি কৃষকরা বিক্রি করতে না পারেন, তাহলে কৃষকরা উৎপাদন বৃদ্ধিতে কোন উৎসাহই দেখাবে না।
Theme images by chuwy. Powered by Blogger.
close