শ্বেত বিপ্লবের ফলাফল, সমস্যা ও সম্ভাবনা

শ্বেত বিপ্লবের ফলাফল, সমস্যা সম্ভাবনা:

স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে অপারেশন ফ্লাড কর্মসূচি চালু করে অল্প সময়ে দুধ উৎপাদনে যে অভাবনীয় বৈপ্লবিক উন্নতি ঘটে তাকে শ্বেত বিপ্লব বলে।
 
দুধ দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনে ভারতে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রথম। ভারতের দুধ আহরণ করা হয় গোরু, মোষ, ছাগল উট (রাজস্থান) থেকে।গোরু, মোষ ছাগল - এর দুধের রং সাদা হয় বলে এই বিপ্লবকে শ্বেত বিপ্লব বলে।
 
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে 1970 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের দুধের উত্পাদন বৃদ্ধি ছিল স্থিতিশীল। স্বাধীনতার পর থেকে দুধ দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনে বৃদ্ধি পায়।
 
কেন্দ্র সরকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপুল চাহিদা পূরণে 1970 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে  National Dairy Development Board স্থাপনের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা অপারেশন ফ্লাড নামে পরিচিত।
 

A. শ্বেত বিপ্লবের ফলাফল:

ভারতে জাতীয় আয়ের একটা বড় অংশ আসে দুধ দুগ্ধজাত শিল্প থেকে। ভারতের দুধ উৎপাদনের উন্নতি ঘটেছে সমবায় প্রথার মাধ্যমে। শ্বেত বিপ্লব ভারতের অর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে সাফল্য এসেছে সেগুলি হল -
 
1. গৃহপালিত পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি: শ্বেত বিপ্লবের ফলে পশুপালন আয়ের অন্যতম উৎস হওয়ায় গৃহপালিত পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি হয়।
 
2. দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি: ভারত বিশ্বে দুধ উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ভারতে দুধের উৎপাদন প্রায় 6/7 গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হলে দুধ দুগ্ধজাত দ্রব্য আমদানি ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে।
 
3. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি: শ্বেত বিপ্লবের প্রসারের ফলে গ্রামাঞ্চলে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বিপুল মাত্রা বৃদ্ধি পায়, ফলে গ্রামীণ মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতাও বৃদ্ধি পায়।
 
4. আয়ের নতুন উৎস: কৃষি ক্ষেত্র ছাড়া ভর্তি পশু পালনের মাধ্যমে যে উপার্জন করা সম্ভব এই বিশ্বাস গ্রামীণ মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই নতুন পথ সৃষ্টির মাধ্যমে এদের মধ্যে মানসিকতাও পরিবর্তন ঘটেছে।
 
5. নারীর ক্ষমতায়ন:  দোহ কাজে গ্রামের মেয়েরা পুরুষের তুলনায় বেশি অংশগ্রহণ করে। ফলে দোহ কর্মজাত আয়ের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
6. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন: চাষাবাদ অন্যান্য পেশার কাজের পাশাপাশি দুধ উৎপাদনকেও গ্রামে মানুষ আয়ের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে ছদ্ম বেকারত্ব হ্রাস পেয়েছে এবং ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষী এবং ক্ষেতমজুরদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটেছে।
 
7. পরিকাঠামোর উন্নতি: শ্বেত বিপ্লবের কারণে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিকাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে। সরকারী বেসরকারী স্তনের দুধ উৎপাদনকারী পরিকাঠামো উন্নতির যে সকল কাজ হয়েছে সেগুলি হল সংরক্ষণ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি, উন্নত মানের পশু খাদ্য উৎপাদন, গবাদিপশুর জন্য কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন গবাদিপশু বিমা প্রকল্প প্রভৃতি।
 
8. দুধ শিল্পের বিকাশ: শ্বেত বিপ্লবে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার কাজ, প্রযুক্তি অন্যান্য সহযোগী শিল্পের প্রসার ঘটেছে। অধিক দুধ উৎপাদনকারী উন্নত প্রজাতির গরুর প্রজাতির উদ্ভাবন ঘটানো হয়।
 

B. ভারতের শ্বেত বিপ্লবের সমস্যা:

শ্বেত বিপ্লবের অনেক সুফলের পাশাপাশি বেশ কিছু সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
 
1. অনুন্নত পরিবহন: দুধ পচনশীল বস্তু হওয়ার কারণে দুধকে সঠিক সময়ের মধ্যে উৎপাদন কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া আবশ্যক। ভারতে অনুন্নত পরিবহন ব্যবস্থার জনিত কারণে দূর-দূরান্তে গ্রাম থেকে দুধ সংগ্রহ সমস্যা দেখা দেয়। ফলে প্রতিদিন অনেক দুধ নষ্ট হয় এবং কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
 
2. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ: অধিক উষ্ণতা পরিকাঠামোর অভাবের কারণে ভারতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গবাদিপশু পালনের জন্য বেশিরভাগ সময় এরা বিভিন্ন রোগের শিকার হয়। ফলে দুধের উৎপাদন হ্রাস পায়।
 
3. উন্নত প্রজাতির গবাদিপশুর অভাব: ভারতে এখনো সঠিক মানের উন্নত প্রজাতির গবাদিপশুর অভাব দেখা যায়। ভারতের গবাদিপশুর দুধ উৎপাদন করার ক্ষমতা উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেকটা কম।
 
4. বিচ্ছিন্ন প্রাচীন সংগ্রহ পদ্ধতি: ভারতের দুধ উৎপাদন ক্ষেত্র গুলি বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এবং প্রাচীন পদ্ধতিতে দুধ সংগ্রহের জন্য উৎপাদনশীলতা অনেক কম।
 
5. বিপণনগত সমস্যা: সারাদেশের দুধ দুধ বিক্রির সঠিক ব্যবস্থার অভাবে সব স্থানে দুধ সরবরাহ বিক্রি করা যায় না। যা আর্থিক উন্নয়ন বিকাশের অন্যতম বাঁধা।
 

C. ভারতের শ্বেত বিপ্লবের সম্ভাবনা:

1. বিপুল চাহিদা: অধিক জনসংখ্যা বিশিষ্ট ভারতে দুধ দুগ্ধজাত দ্রব্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে। যা শ্বেত বিপ্লবের উন্নতির প্রধান সুযোগ।
 
2. আন্তর্জাতিক বাজার: বিশ্বায়নের সুবাদে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় দুগ্ধপণ্য বিক্রির সুযোগ রয়েছে।
 
3. বিমা প্রকল্প: গবাদিপশু বিমা প্রকল্পে গ্রামাঞ্চলে গবাদিপশু পালন ঝুকিহীন হওয়ায় গবাদিপশু পালন বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
4. উন্নত প্রজাতি বৃদ্ধি: দেশের বিভিন্ন গবাদিপশু প্রজনন কেন্দ্র থেকে এবং বিদেশ থেকে আমদানি করে উন্নত প্রজাতির গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
5. দুধ শিল্পকেন্দ্র স্থাপন:  সারাদেশে অসংখ্য দুগ্ধজাত শিল্পকেন্দ্র স্থাপনের ফলে শ্বেত বিপ্লবের উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।

Theme images by chuwy. Powered by Blogger.
close