নীল বিপ্লবের ফলাফল, সমস্যা ও সম্ভাবনা

নীল বিপ্লব (Blue Revolution):

স্বাধীনোত্তর ভারতে সত্তরের দশকে ভারত সরকারের উদ্যোগে উন্নত আধুনিক মৎস্য প্রজনন, আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ বিপণন ব্যবস্থার ফলে অল্প সময়ে স্বাদু লবণাক্ত জলের মৎস্য উৎপাদনে যে বৈপ্লবিক অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটে, তাকে নীল বিপ্লব বলে।
 
মাছের আবাসস্থল জলের রং মূলত নীল হওয়ায় একে নীল বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়।

নীল বিপ্লবের জনক: . অরূপ কৃষ্ণান হলেন ভারতের নীল বিপ্লবের জনক।
 
অধ্যাপক হীরালাল চৌধুরী হলেন ভারতের গোলাপি বিপ্লবের জনক (চিংড়ি চাষ)
 
কার্যকর অঞ্চল:  ভারতের যে সকল রাজ্যগুলিতে সামুদ্রিক অন্তর্দেশীয় মৎস্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছিল সেগুলি হল পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, গুজরাট, কেরল, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক বিহার প্রভৃতি।
 

A. নীল বিপ্লবের ফলাফল:

ভারতের অর্থনীতিতে নীল বিপ্লব ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। যেমন
1. মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি: নীল বিপ্লবের ফলে ভারতে অভ্যন্তরীণ সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিপুল জনসংখ্যার বৃদ্ধি পেলেও ভারত মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে।
 
2. পুষ্টিকর খাদ্য: মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের গ্রামীণ মানুষের কম দামে পুষ্টিকর খাদ্যের যোগান সম্ভব হয়।
 
3. কর্মসংস্থান: মাছ চাষ মৎস্য শিল্পের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে কৃষির পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
4. আয় বৈদেশিক মুদ্রা: নীল বিপ্লবের ফলে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মৎস্য বাণিজ্যে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন বৃদ্ধি ঘটেছে।
 
5. মৎস্য শিল্পের বিকাশ: নীল বিপ্লবের ফলে মৎস্যশিল্পের গবেষণা কাজ প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং মৎস্য ভিত্তিক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং সার, ওষুধ সরবরাহ, বিভিন্ন উপকরণ নির্মাণ শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।
 
6. পরিকাঠামো উন্নতি: নীল বিপ্লবের ফলে মাছ সংরক্ষণ, পরিবহন ব্যবস্থা, মৎস্য বিমা, কৃত্রিম প্রজনন মৎস্যজীবীদের ঋণ প্রদান প্রভৃতি পরিকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে।
 
7. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন: এই বিপ্লবের ফলে ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষি এবং জেলেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটে কর্মসংস্থান আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে।
 
বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, মহারাষ্ট্র গুজরাট প্রভৃতি স্থানে উপকূলবর্তী লক্ষ লক্ষ মানুষ মৎস্যচাষকে কেন্দ্র করে উন্নতি লাভ করেছে।
 

B. নীল বিপ্লবের সমস্যা:

নীল বিপ্লবের ফলে ভারতে মৎস্য চাষে প্রভূত উন্নতি হলেও বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন
 
1. ব্যয়বহুল: ভারতের অধিকাংশ মৎস্যজীবী গরিব হওয়ায় আধুনিক ব্যয়বহুল উন্নত জাল, ট্রলার হিমায়ন ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারে না।
 
2. অভ্যন্তরীণ মৎস্য ক্ষেত্র দূষণ বৃদ্ধি: দেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য ক্ষেত্র গুলি, বিশেষ করে নদী-খাল-বিল প্রভৃতির জল কৃত্রিম খাদ্য ওষুধ প্রয়োগের কারণে ক্রমশ দূষিত হয়ে পড়েছে। ফলে মাছের রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
 
3. উপকূলভাগে ভূমিক্ষয়: উপকূলবর্তী এলাকার ম্যানগ্রোভ অরণ্য অঞ্চল জলাভূমি গুলিতে চিংড়ি চাষ বৃদ্ধির কারণে উপকূলভাগে ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
4. আঞ্চলিক বৈষম্য: ভারতের সর্বোচ্চ নীল বিপ্লব সমানভাবে সাফল্য লাভ করতে পারেনি। পূর্ব দক্ষিণ ভারতের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও ভারতের অন্যান্য অংশ বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ভারতের মৎস্য চাষের তেমন উন্নতি ঘটেনি।
 
5. আধুনিক পরিকাঠামোর অভাব: ভারতের সর্বোচ্চ এখনো প্রয়োজনমতো মাছ সংরক্ষণের আধুনিক পরিকাঠামো ঘরে তোলা সম্ভব হয়নি এবং মৎস্য সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত উপকরণ মৎস্যজীবীরা এখনো পায় না।
 
6. প্রাকৃতিক বিপর্যয়: অনিশ্চিত মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যা খরাতে স্থলভাগের পুকুর, নদী জলাশয় মাছ উৎপাদন বিঘ্নিত হয় এবং  প্রবল ঝড়-বৃষ্টি ঘূর্ণবাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ওড়িশা উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলে মাছের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
 
7. পরিবেশ জীববৈচিত্রের ক্ষতি: উপকূল অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতের ম্যানগ্রোভ অরণ্য অঞ্চল সর্বাধিক ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে এবং বেশ কিছু স্থানীয় মাছের অবলুপ্তি ঘটে।
 

C. নীল বিপ্লবের সম্ভাবনা:

1. মৎস্য উৎপাদন: মাছ উৎপাদনে ভারতে এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ভারতের মাছ উৎপাদনে এই অবস্থান মৎস্যচাষে অর্থ শ্রম বিনিয়োগে উৎসাহ যোগাচ্ছে।
 
2. বিপুল চাহিদা: অধিক জনসংখ্যা বিশিষ্ট দেশ ভারতে মৎস্য জাতীয় প্রোটিন খাদ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে।
 
3. প্রশিক্ষণ, ঋণ বিমা: সরকারিভাবে মৎস্যজীবীদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং মৎস্য চাষের জন্য বিভিন্ন ঋণ মৎস্যজীবীদের বিমার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
 
4. EEZ অঞ্চল: দেশের EEZ (Exclusive Economic Zoneঅঞ্চলে সম্পদ সংগ্রহের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করার জন্য বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান সমীক্ষার কাজ জারি রয়েছে।
 
5. স্যাটেলাইট প্রযুক্তি: অভ্যন্তরীণ সম্পদ সামুদ্রিক সম্পদ পর্যবেক্ষণের জন্য ভারত সরকার RESOURCE SAT এবং OCEAN SAT পর্যায়ের উপগ্রহ পাঠিয়েছে। উপগ্রহের মাধ্যমে মাছ ধরার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলি সম্পর্কে তথ্য বিশ্লেষণ করে চিন্তা করা যাবে।
 
Theme images by chuwy. Powered by Blogger.
close