মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য

আরবি শব্দ 'মৌসিম' বা মালয়ি শব্দ 'মনসিন' থেকে মৌসুমী শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে যার অর্থ 'ঋতু' ঋতু অনুসারে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকেই বলে মৌসুমী বায়ু
 
দক্ষিণ দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ায় যে বায়ু প্রবাহ প্রায় 6 মাস দক্ষিণ- পূর্ব দিক থেকে 6 মাস উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয় সেই বায়ুপ্রবাহকে আদর্শ মৌসুমী বায়ু বলে। মৌসুমী বায়ু হল স্থলবায়ু সমুদ্রবায়ুর বৃহৎ সংস্করণ।
 
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি  সর্বপ্রথম মৌসুমী শব্দটি ব্যবহার করেন।
 
নিরক্ষরেখার উভয়দিকে গড়ে 10° থেকে প্রায় 25° অক্ষরেখার মধ্যে বছরের অধিকাংশ সময়ে ঋতু অনুসারে বিপরীতমুখী বায়ু প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত জলবায়ুকে মৌসুমী জলবায়ু বলে। কোপেনের জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগে মৌসুমী জলবায়ুকে 'Am' অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
 
মৌসুমি জলবায়ুর অবস্থান:
A. অক্ষাংশগত অবস্থান:
নিরক্ষরেখার উভয়দিকে গড়ে 10° থেকে প্রায় 25°  অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে মৌসুমী জলবায়ু বিরাজ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে এই জলবায়ু অঞ্চল প্রায় 30° উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
 
B. দেশিয় অবস্থান:
I. মুখ্য অঞ্চল: ভারতীয় উপমহাদেশে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশে মৌসুমী জলবায়ু প্রধানত দেখা যায়।
 
II. গৌণ অঞ্চল: আফ্রিকার মোজাম্বিক মাদাগাস্কার, দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলা, সুরিনাম গিয়ানা, উত্তর আমেরিকার ফ্লোরিডা উপকূল মেক্সিকোর পূর্ব দক্ষিণ উপকূল এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় মৌসুমী জলবায়ু দেখা যায়।
 
 

মৌসুমী জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য:

ঋতুভিত্তিক বৈশিষ্ট্য এবং অনিশ্চয়তা অনিয়মের উপর ভিত্তি করে মৌসুমি জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি হল
 
1. উষ্ণতা:
দুই বিপরীতধর্মী মৌসুমী বায়ুর আগমন প্রত্যাবর্তনে এই জলবায়ু অঞ্চলে বার্ষিক উষ্ণতার তারতম্য দেখা যায়। বার্ষিক উষ্ণতার তারতম্যের ভিত্তিতে নিম্ন বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়
 
I. ঋতু পর্যায়: উষ্ণতা আর্দ্রতার তারতম্য মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে চারটি সুনির্দিষ্ট ঋতু দেখা যায়। যথা
A. উষ্ণ শুষ্ক গ্রীষ্মকাল (মৌসুমী বায়ুর আগমনের আগে)
B. উষ্ণ আর্দ্র গ্রীষ্মকাল (মৌসুমী বায়ুর আগমন)
C. শরৎকাল (মৌসুমী বায়ুর প্রত্যাবর্তন)
D. শুষ্ক শীতল শীতকাল।
 
II. গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা: এই জলবায়ু অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন গড় উষ্ণতা 27 ° থেকে 32 ° সেন্টিগ্রেট হয়ে থাকে।
 
III. শীতকালীন উষ্ণতা: এই জলবায়ু অঞ্চলে শীতকালে উষ্ণতা থাকে প্রায় হাজার 10 ° থেকে 22 ° সেন্টিগ্রেড।
 
IV. উষ্ণতার প্রসর: এই জলবায়ু অঞ্চলে উষ্ণতার বার্ষিক প্রসর 2 ° সেন্টিগ্রেড থেকে 11 ° সেন্টিগ্রেট হয়।
 
2. বায়ুর চাপ:
I. গ্রীষ্মকালীন বায়ুর চাপ: মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পতিত হয় ফলে উত্তর পশ্চিম ভারত মধ্য এশিয়ার স্থলভাগের উপর অত্যাধিক উষ্ণতায় গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।
 
II. শীতকালীন বায়ুর চাপ: শীতকালে সূর্যের দক্ষিণায়নের সঙ্গে উত্তর পশ্চিম ভারত মধ্য এশিয়ার স্থলভাগের উষ্ণতা হ্রাস পেয়ে উচ্চচাপ কেন্দ্র সৃষ্টি হয়।
 
3. বায়ুপ্রবাহ:
বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ হয় মৌসুমি জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বায়ুপ্রবাহ গুলি হল
 
I. দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু: গ্রীষ্মকালে স্থলভাগের নিম্নচাপ জলভাগে উচ্চচাপ অবস্থান করায় সমুদ্র থেকে স্থলভাগের দিকে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়।
 
II. উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ু: শীতকালে স্থলভাগের উচ্চচাপ এবং জলভাগে নিম্নচাপ থাকায় স্থলভাগ থেকে সমুদ্রের দিকে উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়।
 
III. স্থানীয় বায়ু: এই জলবায়ু অঞ্চলে এপ্রিলমে মাসে পশ্চিমবঙ্গ উড়িষ্যা বাংলাদেশ কালবৈশাখী, দক্ষিণ ভারতে আম্র বৃষ্টি, উত্তর পশ্চিম ভারতে লু আঁধি নামক স্থানীয় বায়ু প্রবাহিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে আশ্বিনের ঝড় দেখা যায়।
 
IV. ঘূর্ণিঝড়: প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমী বায়ু দক্ষিণপশ্চিম মৌসুমি সংঘর্ষে শরৎকালে ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন সৃষ্টি হয়।
 
4. বৃষ্টিপাত:
I. বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ: মৌসুমী জলবায়ুযুক্ত দেশ সমূহে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 150 থেকে 200 সেমি হয়।
 
II. অসম বন্টন: মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের আঞ্চলিক বৃষ্টিপাতের বন্টন ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পর্বতের অবস্থান সমুদ্র থেকে দূরত্বের ওপর মৌসুমী বৃষ্টিপাত নির্ভর করে।
 
III. অনিয়মিত বৃষ্টিপাত: অনিয়মিত প্রকৃতির জন্য মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রত্যেক বছর সমান থাকে না। দুই বছর একই সময়ে মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয় না অর্থাৎ কোন বছর বর্ষাকালের শুরুতে অধিক বৃষ্টিপাত তো কোন বছর বর্ষাকালের শেষে অধিক বৃষ্টিপাত হয়।
 
IV. শীতকালীন শুষ্কতা: শীতকালে উত্তরপূর্ব মৌসুমি বায়ু স্থলভাগ থেকে আসে বলে বৃষ্টিপাত হয় না অর্থাৎ শীতকাল শুষ্ক প্রকৃতির হয়।
 
V. শীতকালীন বৃষ্টিপাত: উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ুর একটি অংশ বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে এসে করমন্ডল উপকূলে শীতকালে বৃষ্টিপাত ঘটায়।
 
VI. বৃষ্টিপাতের ছেদ: মৌসুমি বৃষ্টিপাত ধারাবাহিকভাবে হয়না মাঝে মাঝে বিরতি দেখা যায়, একে মৌসুমী বৃষ্টিপাত বলে।
 
VI. বন্যা খরা: অনিশ্চিত অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের বণ্টনের জন্য মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে বন্যা খরা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা এবং অনাবৃষ্টির ফলে খরা সৃষ্টি হয়ে থাকে।
 
5. তুষারপাত:
শীতকালে ITCZ নিরক্ষরেখা থেকে দক্ষিণেশ্বর এগিয়ে অবস্থান করায় বায়ুচাপ বলয় গুলিও কিছুনা দক্ষিণেশ্বরে যায়। তখন উত্তর ভারতে পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে ভূমধ্যসাগর থেকে আগত জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু উত্তর পশ্চিম ভারতে বৃষ্টি তুষারপাত ঘটায়। এই ঘটনা পশ্চিমী ঝঞ্জা নামে পরিচিত। তাছাড়া শীতকালে শীতল পার্বত্য অঞ্চলে তুষারপাত হয়।
 
6. মৌসুমি বিস্ফোরণ:
জুন মাসের শুরুতে দক্ষিণপশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আরবসাগরীয় শাখা পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় এবং  বঙ্গোপসাগরীয় শাখা পূর্ব হিমালয় প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়, একে মৌসুমি বিস্ফোরণ বলে।

Theme images by chuwy. Powered by Blogger.
close