ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ফল উৎপাদনের উন্নতির কারণ:
পৃথিবীর সর্বাধিক ফল উৎপাদিত হয় ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে। ফল উৎপাদন কৃষির সর্বাধিক বিকাশ দেখা যায় উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু 30° থেকে 45° অক্ষাংশের মধ্যে বিশেষত ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর দেশ গুলিতে। এই দেশ সমূহের জাতীয় অর্থনীতির অনেকটাই স্থান জুড়ে অবস্থান করছে বাজারকেন্দ্রিক উদ্যান কৃষি ও ফল উৎপাদক কৃষি।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু প্রভাবিত অঞ্চল:
ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশ সমূহ গুলি হল –
A. দক্ষিণ ইউরোপ: স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, পর্তুগাল, গ্রীস প্রভৃতি।
B. উত্তর আফ্রিকা: মিশর, লিবিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো ইত্যাদি দেশ।
C. পশ্চিম এশিয়া: তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন, ইজরায়েল প্রভৃতি।
D. পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের দেশসমূহ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চল, অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ উপকূল, নিউজিল্যান্ডের উত্তরের অংশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন অঞ্চল প্রভৃতি।
ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহে ফল উৎপাদন উন্নতির কারণ:
ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে ফল উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য কারণ গুলি হল –
1. অনুকূল জলবায়ু: ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে গ্রীষ্মকাল শুষ্ক ও শীতকাল আর্দ্র প্রকৃতির হয়। গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা বেশি ও শীতকালে সর্বনিম্ন 10 ডিগ্রি সেলসিয়াসে কাছে থাকে এবং বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 30 থেকে 60 সেমি। এরূপ জলবায়ুগত পরিবেশ টকজাতীয় ফল উৎপাদনের আদর্শ। তাই এখানে পাতলা খোসা অধিক শাঁসযুক্ত রসালো বিভিন্ন টক জাতীয় ফল উৎপাদিত হয়।
2. ভূমিরূপ: এখানকার সমতল ভূমিতে জলপাই, আঙ্গুর জাতীয় ফল চাষ হয় এবং পার্বত্য ভূমিতে বিভিন্ন ধরনের লেবু, আপেল জাতীয় ফলের চাষ হয়।
3. উপযোগী মৃত্তিকা: নদী অববাহিকা ও উপকূলীয় অঞ্চলে উর্বর পলিমাটি ও দোআঁশ মাটি নানা প্রকার ফল চাষের বিশেষ উপযোগী হয়।
4. জলসেচ: বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় জলসেচের প্রয়োজন হয়। তাই অতি উন্নত ও আধুনিক পদ্ধতিতে এখানে জলসেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে ফল চাষ করা হয়। নদীর প্লাবনভূমিতে সমৃদ্ধ ভৌমজলেরস্তর অবস্থান করায় সেচের কোন অসুবিধা হয় না।
5. জমির প্রাচুর্য: সমভূমির জমিগুলোতে জলপাই, ডুমুর ও পাহাড়ের ঢালু জমিতে আর্দ্র ও শীতল পরিবেশে আপেল, আঙ্গুর, বিভিন্ন লেবু চাষ করা হয়। এছাড়াও উপকূলীয় সমভূমিতে নারকেল, খেজুর, কাজুবাদাম ও তরমুজ চাষ করা হয়।
6. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার: ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অন্তর্গত দেশগুলিতে ফল উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির সুলভ ব্যবহার করা হয়। যেমন আধুনিক যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক সার, উচ্চফলনশীল বীজ প্রভৃতি। বর্তমানে রোগপোকার উপদ্রব কমানোর জন্য আকাশ থেকে কীটনাশক স্প্রে করা হয়।
7. সুলভ অদক্ষ শ্রমিক: ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলি জনবহুল হওয়ায় শ্রমিকের কখনো অভাব হয় না। ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, ইজরায়েল ও তুরস্ক প্রভৃতি দেশগুলির শিক্ষা ও প্রযুক্তি উন্নত হওয়ায় সুদক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায়।
8. মূলধন: ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলি যথেষ্ট সম্মৃদ্ধ হওয়ায় ফল উৎপাদন কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনের কখনো অভাব হয় না।
9. উন্নত পরিবহন: এই দেশগুলোতে পরিমাণ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত হওয়ায় উৎপাদিত ফলসমূহ খুব দ্রুত বাজারে ও খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ কারখানায় নিয়ে যাওয়া যায়।
10. ফল প্রক্রিয়াকরণ: এই অঞ্চলে ফলের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শিল্প গড়ে উঠেছে। যেমন- জ্যাম, জেলি, জুস অলিভঅয়েল, মদ্যশিল্প প্রভৃতি। এইসব খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নতি লাভ করার ফলে বিপুল পরিমাণে চাহিদার জন্য ফল উৎপাদন কৃষির উন্নতি ঘটেছে।
11. আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা: দীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলের ফলের আন্তর্জাতিক চাহিদা বেশি। বেশ কয়েকটি ফল পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপন্ন হলেও জলবায়ুগত কারণে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ফলগুলোর গুণগত মান ভালো হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা খুব বেশি রয়েছে।